top of page

এক রিফ্যুজি কিশোরের স্মৃতিকথাঃ মুক্তিযুদ্ধে আমার সম্পৃক্ততা

নবম পর্ব




ইতিমধ্যে আজিজ কাকা আসলেন আমাদের ক্যাম্পে একদিন অনেক দিন পর - বললেন উনি ত্রিশ পঁয়ত্রিশ জন নেতাদের নিয়ে ট্রেনিং এ গিয়েছিল - ওনার ঐ সব জায়গা পরিচিত আগে এক দুইবার ইতিমধ্যে গিয়েছেন । বলল আমাদের জন্যও এই ক্যাম্পের আসে পাশে একটা সেন্টার খুলা হবে সহসা । আমাকে বলল মুন্না মিয়া মনে মনে তৈরি হও । তারপর বললেন আগামী সপ্তাহ থেকে প্রত্যেক দুই দিন পর পর গাড়ী আসবে এবং ক্যাম্প থেকে যে কয় জন পারা যায় সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে আগরতলা জি, বি হসপিটালের ‘' জয় বাংলা ‘' ওয়ার্ডে নার্সদের হেল্পার হিসাবে - ঐ খানে শত শত মুক্তিযোদ্ধা আহত অবস্থায় চিকিৎসা নিচ্ছে ; নার্স - ডাক্তার - ব্লাড - হেল্পার এর ভীষণ অভাব । তাই আমাদের ক্যাম্প থেকে যে কয়জন পারা যায় সাথে নিয়ে যেতে হবে - প্রথম কোয় দিন কাকা নিজে আসবেন ড্রাইভার সহ তারপর শুধু ড্রাইভার আসবে ; কাকা আমাকে নিয়ে মাক্কু মিয়ার সাথে কথা বললেন , কথা বললেন ডাক্তার বিসম্বর বাবুর সাথে, কথা বললেন রবি  বাবুর সাথে, মোস্তফা ভাই এবং মিতা ভাবীর  ( মিতা ভাবী এর স্বামী যে কে ছিলেন এবং ওনার নাম কি আজ আর মনে নাই - ভাবী আমাদের সবার খুবি প্রিয় ছিলেন - সারাক্ষণ কলা খেতে পছন্দ করতেন - জানিনা উনারা আজ কোথায় ? ) সাথে ।


আগরতলা জি বি হসপিটাল - জয় বাংলা ওয়ার্ড



 সবাই এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল । আজিজ কাকা ছিলেন তখন আগরতলার মধ্যে খুবি একজন ক্ষমতাশালী অর্গানইজার এবং শেখ ফজলুল হক মনি’র সবচেয়ে বিসস্থ ব্যাক্তি । রাতদিন কাজ করতেন ; একটা দিনও সে ছুটি নেয় নাই মুক্তি যুদ্ধের সময় । কাকা বললেন আমেনা কলকাতা থেকে এসেই আমাদেরকে একটা ছোট্ট খাটো ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করবেন । তারপর আমরা পুরোদমে হসপিটালে কাজ করতে থাকব । যা’ বলা তাই কাজ আপা এবং ঈভা নাগ আর  কয়েকজন মিলে মোট ছয় জন এবং আমি যাবার জন্য তৈরি হয়ে গেলাম চটজলদি । গাড়ী আসলেই আমরা তৎক্ষণাৎ রেডি হয়ে উঠে যেত পারবো কয়েক মিনিটের মধ্যে । যদিও কাকা বলে গেলেন আগামী সোমবার থেকে যাবার কথা , ড্রাইভারকে আমাদের সাথে পরিচয়ও করিয়ে দিলেন । 





আমাদের পাশের রুমটাকে সবাই রিহারসেল, মিলনস্থল এবং স্কাউট - কাব দের কেন্দ্রে  হিসাবে বিবেচনা করতে শুরু করলো ; মোস্তফা দাদা বাশ দিয়ে স্টেনগ্যান, এল , এম , জি বানালো আমাদের আগামী অনুষ্ঠানের জন্য , মাদুর, ধারী বিছিয়ে, দুইটা বেঞ্চ ও বানিয়ে ফেললেন গাছের ডাল আর ক্যাম্প বানানোর সময়কার পরিত্যাক্ত বাঁশ দিয়ে বেঞ্চের পাটাতন এবং পায়াও বানালো । বেশ একটা সুন্দর জায়গা হয়ে উঠলো ঐ রুমটা । ঐ রুমের পাশেই মেইন  গেট এবং একটা বিরাট ঢালু একটা লাল মাটির সেন্ট্রাল এভেনু - মেইন স্কয়ার এর মত  ; ওখানেই আমরা সাত চারা খেলতাম, ডাংগুলি খেলতাম এবং যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতাম । খেলার সব সরঞ্জাম ঐ রুমেই রাখতাম । ক্লভিচ, শিটবেনড, বোলাইন সহ অন্যান্য সব গুলো স্কাউট এর গিট্টু বাধা শিখলাম । বেডেন পাওেল হয়ে গেলো আমাদের অদেখা এক প্রবাদ পুরুষে। 



জয় বাংলা পেপার আমি বিতরণ করতাম


ঐ রকম এক সকালে আমরা কয়জন আমাদের   মেইন স্কয়ার এ কেবল সাত চারা খেলতে শুরু করবো তখন আজিজ কাকা তার সেই কাইসার ছি যে সিক্স জিপ নিয়ে ক্যাম্পে ঢুকলেন । গাড়ীর সামনের ছিটে বসে আছেন শেখ মনি ( আমরা মনি মামা বলে ডাকতাম - কারন ফুফুর ছেলে লিটন এবং চন্দন ওনাকে ঐ নামে সম্বোধন করত ) সেই দিন আমি আর রনি ( এম পি এডভোকেট  সিরাজুল হক  এর ছোট ছেলে - বাংলাদেশের আইন মন্ত্রী আনিসুল হকের একমাত্র ভাই  - আমাদের ক্যাম্পের বড় ভাই শামীম, ফরহাদ ও নাফিজ ভাইদের খালাতো ভাই - ওরা দুই ভাই প্রায়ই আসতো আমাদের ক্যাম্পে - ওখান থেকেই আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম ) কেবল খেলা শুরু করব ; গাড়ী থেকে দুজনাই নেমে আমাদের দুই জনকে কাছে ডাকল - ড্রাইভার  পিছন থেকে একটা বস্তা নামালো । ঐ বস্তা থেকে কয়েকটা পত্রিকা বের করে আনলেন মনি মামা এবং বললেন আজ থেকে তোমরা দুইজন এই পেপার গুলো সবাইকে বিনামূল্যে বিতরণ করবা । এখানে , আসে পাশের অন্য সব গুলো শরণার্থী শিবিরে, ইয়ুথ ক্যাম্পে, আগরতলায় , যেদিন গাড়ী এসে তোমাদের নিয়ে যাবে আগরতলা ঐ দিন তোমরা দুইজন সাথে যত গুলো পারবে এই ‘' জয় বাংলা ‘' পেপার নিয়ে যাবে - আর গাড়ী থেকে নেমে যাবে আগরতলার আখাউরা রোডের মোড়ে - ওখানে নেমে ভারতীয় এবং জয় বাংলার যত লোক পাবে তাদেরকে এই পত্রিকাটা দিবে । আর যেদিন তোমরা আগরতলা যাবে না সেই দিনগুলোতে আসে পাশের এলাকায় দিবে ; বলে আমাদের দুজনকে ২০ রুপির একটা নোট দিয়ে বলল - এটা শেষ হলে আবার পাবা কিন্তু পত্রিকাগুলো সব বিতরণ করতে হবে । সেই এক বিশাল গম্ভীর ব্যারিটোন গলার আওয়াজ - হাল্কা পাতলা শুকনো একজন মানুষ কিন্তু গলার আওয়াজে আমরা দুইজনই ভঁয়ে থরথর হয়ে কাঁপছিলাম । আজিজ কাকা আস্তে করে বলল  লিডারও আমাদের সিরাজ ভাইয়ের ছেলে রনি - কাকা ওদের পরিবারকে খুব ভালো করেই চিনতেন - সিরাজ সাহেব আমাদের কসবার সংসদ সদস্য ।  - ওটা শুনার পর আমাদের দুজনের পীঠ চাপড়ে দিলেন মনি মামা । আমি তো অকুতোভয় এক বালক বললাম হাসতে হাসতে - জি সব বিলি করে দিব - জয় বাংলা - হায়রে আমার স্বাধীনতা যুদ্ধ - কেউ  কোন দিনও জানতে পারবে না - কত বড় যে ছিল আমাদের মননে স্বাধীনতা যুদ্ধ ! 


যা বলা তাই কাজ - আধা ঘণ্টা পড় আমরা ৭ জন গাদাগাদি করে জীপে চড়ে বসলাম - খালি রাস্তা - সূর্যমণি নগর থেকে আগরতলা মাত্র ৪- ৫ মাইল দূরে, বেশ সহসায় আমরা পৌঁছে গেলাম ; কাকা গাড়ীটা দার করিয়ে আমাদের দুজন কে নামিয়ে দিল - আর বলল পেপার বিতরণ শেষ করে  জি, বি হসপিটালের জয় বাংলা ওয়ার্ডে চলে আসবা ওখানে এরা সবাই থাকবে  ;  সারা রাস্তা মনি মামা নীরবে সিগারেট টানতে থাকলো নিজের মাঝে নিজে হারিয়ে গেলো বলে মনে হল । এই রাস্তা দিয়ে সোজা গেলেই সামনে পাবা সেই বিশাল হাসপাতাল । বিশ মিনিট লাগবে হাটতে ; আমরা শুরু করে দিলাম পেপার বিতরণ । সবাই আমাদের কাছ থেকে পেপার নিতে থাকলো । দারুণ সেই অনুভূতি , নিজেকে মত হতে লাগলো একজন বড় ব্যাক্তি। দারুন সেই উপলব্ধি - নিমিষেই ভুলে গেলাম পেট ভঁরে না খাওয়ার দুঃখ, আব্বার অসুস্থতা , আম্মার নিদারুণ কষ্ট, সারারাত বার বার পাকিস্তান আর্মির আক্রমণ এর মাধ্যমে নিহত হবার ভঁয় । রনি আর আমি হয়ে গেলাম অবিচ্ছেদ্য বন্ধু সেই দিন থেকে । ভীষণ একটা ভাল এবং ভদ্র ছেলে ছিল রনি । একটা জোকারও ছিল সে । পেপার যত গুলো নিয়ে এসেছিলাম তা দুই ঘণ্টায় বিলি করে আমরা দুজন দুইটা সিঙ্গারা খেলাম আর কিছু চানাচুর ভাজি কিনে হেটে হেটে হাসপাতালের দিকে হাটতে শুরু করলাম তখন প্রায় সাড়ে চারটা বাজে । রনি দেখালাম কোন সিনেমা হলে আমি হাতি মেরা সাথী ফিল্ম দেখেছিলাম । হাসপাতালের সাইনদেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম জি, বি হসপিটালে । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এই প্রতিষ্ঠানটির নাম ; এই সেবাস্থলের কাছে আমরা বাঙ্গালীরা আজীবন কৃতজ্ঞ । এখানে আগেও এক দুবার এসেছিলাম আমাদের গ্রামের আমাদের গোসটির সম্পর্কে ভাই এবং অনেক আরও পরিচিত আত্মীয় মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়ে এই ‘' জয় বাংলা ‘' ওয়ার্ডে চিকিৎসা পেয়েছে । ছোট্ট ওয়ার্ড বেশি হলে ত্রিশ টা বেড থাকার কথা সেই জায়গায় প্রায় ২ রোগী - বারান্দায়, ফ্লোরে, করিডোরে খালি যুদ্ধাহত মুক্তি আর মুক্তি । হাহাকার, কান্না, ব্যথা আর যন্ত্রণায় সে এক বিভীষিকাময় স্থান এই জয় বাংলা ওয়ার্ড । চোখের পানি সংবরণ করা এক ভীষণ কঠিন কাজ এখানে আসলে - এরা সব আমার স্বাধীনতার জন্য করছে এই আত্মত্যাগ -  জীবন দিতে তৈরি এই যুবক, এই কৃষক, এই ছাত্র, এই সৈনিক , এই শিক্ষক, এই আর্মি অফিসার , এই প্রফেসর  । আজ ব্যথায় সবাই কাতরাচ্ছে । জীবন মরণ এর সন্ধিক্ষণে এরা সবাই ; কিন্তু আমি কি যে এক দুর্ভাগা আমি পারছি না এদের সাথে সহ যাত্রী হয়ে যুদ্ধে যেতে । আমার উপর একটা সম্পূর্ণ সংসার নির্ভরশীল, আমি আমার পরিবারের জ্যৈষ্ঠ পুরুষ , আমার অনেক দায়িত্ব এদের জন্য সব কিছু জোগাড় করার জন্য ; কিন্তু আমি জানি যে, আমি অনেক ব্যাপারে অপারগ, আমি দুর্বল, আমি  অনেক সময় রাগী এবং আমি সহ্য করতে পারছি না এই কষ্ট, অসচ্ছলতা এই তকলিফ । আমি কাবু প্রায়, আমি অনেক রুগ্ন এখন , এই জংগল কেটে লাকড়ি আনা আমার জন্য ভীষণ কঠিন একটা কাজ, আমি কলস দিয়ে পানি আনতে আনতে ক্ষিপ্ত এবং প্রচণ্ডভাবে ক্লান্ত ও অবসন্ন । কিন্তু এত কিছুর পরও আমি চাই স্বাধীনতা, আমি চাই মুক্তি, আমি চাই আমাদের অধিকার । আমি মৃত্যুভঁয়ে অস্থির তার পরও আমি যুদ্ধে যেতে চাই এবং আমি করতে  চাই আত্মত্যাগ দেশের স্বাধিকার আদায়ের এই সংগ্রামে । 


সন্ধ্যায় আমাদের নামিয়ে দিলেন জীপে করে - কাকা চলে গেলেন বিশালগড়ে । আপা দুই ভাইয়ের জন্য রান্না করে রেখে গিয়েছিল - ওরাও বেশ স্বাবলম্বী হয়ে গেছে পাশের রুমের নারায়ণগঞ্জের মাসীমা আমাদের খুব খেয়াল করতেন ; বিশাল ব্যবসায়ী ছিলেন ওনারা - তিন বাচ্চা নিয়ে আর ওনার স্বামী আহত অবস্থায় কোন ভাবে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন ; খুবি স্বনামধন্য পরিবার এর ওনারা । নারায়ানগঞ্জের এক নাম করা পরিবার ওরা ; গাড়ী, বাড়ী ফেলে আজ কপর্দকহীন - শম্ভু দাদা ওনাদের বড় ছেলে, ঊষা  দিদি আমার আপার সমবয়সী ছিলেন আর ওদের ছোটভাই তরুণ আমাদের সবচে ছোট ভাই টুম্পার বয়সী ।ওদের এম এল এ শামশুজোহা সাহেব ওনাদের সব সময় খোজ খবর নিতেন এবং এসে দেখে যেতেন ( নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত ওসমান পরিবারের কর্ণধার জোহা সাহেব ; আমরা সবাই ওনাকে নানা বলে সম্বোধন করতাম ) । 


এর পরদিন থেকে আমি, রনি , সমর দা’ , মীঠূ আমরা কয়জন মিলে আমাদের ক্যাম্পের আসে পাশে সব শরণার্থী শিবির গুলতে হেঁটে হেঁটে গিয়ে গিয়ে জয় বাংলা পেপার বিতরণ করতে শুরু করলাম একটা অত্যন্ত পবিত্র দায়িত্ব হিসাবে গ্রহণ করে - সূর্যমণিনগর, আমতলী, আগরতলা - সাভ্রুম রোড ধরে মধুবন, মধুপুর, অরুন্ধুতিনগর , বিক্রমপুর , সেকের কোট ,  চৌমোহিনী বাজার এই সব এলাকায় যত গুলো শরণার্থী শিবির এবং শিবির বিহীন মানুষদেরকে অতি শ্রদ্ধার সাথে পেপার  বিতরণ করলাম । ওরা আমাদের দেওয়া পেপার পেয়েযে কি খুশী হচ্ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না । তিন দিনেই পুরা আড়াই মনের বস্তার পেপার খতম । পেপার না আসা পর্যন্ত আবার স্কাউট এবং যেদিন গাড়ী আসতো সেই দিন জি বি হাসপাতালে যেতাম - অনেক কিছু ওখানেও শিখলাম - যেমন টি শিখেছিলাম ডাক্তার বিসম্বর বাবুর কম্পাউইন্ডার হিসাবে আরনিকা টুয়েন্টি, রাস্ত্রক্স থার্টি  ঠিক তেমনি হাসপাতালে টুলূ আপা হয়ে গেলো পুরা নার্স এর সহযোগী আর আমি ওয়ার্ড বয় কিডনি ট্রে, গজ , ব্যান্ডেজ, মেডিক্যাল ড্রেপ্স, সিরিঞ্জ , স্যালাইন দেওয়া , টুরনিকেট, এপ্রন এই সব রপ্ত করে ফেললাম কয়েকদিনে । সব মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলতাম আর কারো কোন সাহায্য লাগলে করতাম এই ছিল আমার নিত্যনৈমতিক কাজকর্ম । নিজেকে অনেক গর্বিত মনে হত, ঐ সময় একদিন ওয়ার্ডের এক রুগী আসলো পায়ে গুলীঢ় ইনজুরি নিয়ে - সম্ভবত উনি ২৯ হয়তবা ৩৯ নাম্বার বেডে ছিলেন ; বেশ ব্যথায় কাতর, ওনাকে পানি দিতাম, বাংলা পেপার পড়ে শুনাতাম, পায়ে খুব ব্যথা করতো তাই অনেক সময় পা টিপেও দিতাম ; কয়েকদিন থাকল হটাত একদিন যেয়ে দেখি উনি আর নেই - অনেক কে জিজ্ঞেস করলাম কেই কোন ঠিক উত্তর দিতে পারলাম না । তার নাম ছিল বাহার - কুমিল্লা শহরে এক দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধা বয়েস ২০ - ২১ বছর হবে - নাম তার বাহার - আমি তাঁকে এবং টুলূ আপা বাহার ভাই , বাহার বলে ডাকতাম - অনেক বছর পর প্রায় পঞ্চাশ বছর পর আমাদের সেই প্রিয় বীর মুক্তি সেনা বাহার ভাই বেচে  আছে - কুমিল্লা শহরের এক নাম করা বীর মুক্তি যোদ্ধা বাহার বীর প্রতীক - বর্তমানে সে কুমিল্লা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এবং মুক্তিযোদ্ধা নেতা ; একবার টেলিফোনে কথা হয়েছে । ওনার সাথে তাও সে আমার এক সিনিয়ার অফিসার কর্নেল  শাজাহান এর মাধ্যমে ওনারা দুই কাজিন - তার মাধ্যমে । 


জয় বাংলা পেপার আমি বিতরণ করতাম


এর মধ্যে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক   ট্রুপ নিয়ে আরও কয়েকটি মনোরঞ্জন মূলক অনুষ্ঠান করলাম বিভিন্ন ইয়ুথ ক্যম্পে এবং মুক্তি ট্রেনিং সেন্টারে ; গোকুলনগর এর নিকট একটাতে, আমতলী ইয়ুথ ক্যাম্প এ । কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট এই দিয়ে আমাদের প্রোগ্রাম শুরু হত , সে এক লোমহর্ষক অনুভূতি । সে যে কি এক হৃদয় নিংড়ানো অভিনয় সেই অতি অল্প বয়েসেই তা’ প্রকাশ করার মত আমার এত বড় মাপের সাহিত্যিক যোগ্যতা নাই । 



আমাদের গাওয়া সেই গান গুলো আজও মনের সেলুলয়ডে উদ্ভাসিত হয় প্রায়ই

‘' শুনো একটি মুজিবরের কণ্ঠ থেকে লক্ষ মুজিবের কণ্ঠ……’'

''যায় যদি যাক প্রাণ তবু দেবনা গলার ধান … রক্তের দামে কিনেছি মোরা ….''

‘' যে মাটির চির মমতা আমার অঙ্গে মাখা , যার নদী জল ফুলে ফলে মোর সপনো আঁকা…''

‘' পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে , রক্ত লাল রক্ত লাল ‘'

‘' বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান , বাংলার মসুল্মান আমরা সবাই বাঙ্গালি …… মুজিবর, মুজিবর …''

'' কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট ……''

‘' বাংলা মা’র দুর্নিবার আমরা তরুণ দল …।''

ছোট্ট নাটিকাতে বীরাঙ্গনা নারীর চরিত্রে আমার বোন টুলু আপার অভিনয় এবং অভিব্যাক্তি সবার চোখে জল নেমে আসতো অঝরে, দিলীপ হতো পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন - দারুণ তার অভিনয় । মেলাঘর সেই জঙ্গল প্রকম্পিত হয়ে উঠত মুক্তি দের করতালে । আমি সত্যিই একজন ভাগ্যবান যে আমার দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঐ ছোট্ট বয়েসেই আমার কর্তব্য পালন করতে পেরেছিলাম ।



দিন রাত রাত দিন শত শত মুক্তিযুদ্ধারা হাত পা’ নাক,  চোখ বিহীন অনবরত আমাদের ওয়ার্ডে আস্তে লাগলো - ইন্ডিয়ান ডাক্তার , নার্স,ওয়ার্ড বয় এদের কাছে যে আমরা বাঙ্গালীরা কি পরিমাণ ঋণী তা ‘ লিখে শেষ করার কোন ভাষা আমার জ্ঞাত নেই - প্রত্যেক দিন কেই আমাদের ছেড়ে চির বিদায় নিচ্ছে, কেই উন্নত চিকিৎসার  জন্য অন্য বড় হসপিটালে চলে যাচ্ছে , কেউ সুস্থ হয়ে আবার রণাঙ্গনে ফিরে যাচ্ছে - চোখে না দেখলে ঐ অভিজ্ঞতা লেখে বুঝানো অসম্ভব । 


নতুন খবরের সংকলন আবার এসে গেলো  আবার বিতরণ শুরু করলাম নব্য উদ্দীপনায় - রনি চলে গিয়েছল আবার আসল , ওর বড় ভাই সেনন ( আনিসুল হক ; বাংলাদেশ সরকারের আইন মন্ত্রী এবং কসবা'র এম পি )  ও আসলো শুরু হল খবরের কাগজ বিতরণ । এই ভাবেই আমরা পেপার এবং হাসপাতালে কাজ  এ করতে থাকলাম ১৫ ই ডিসেম্বর অবধি । এতসব কর্মকাণ্ড করতে করতে দিন তো পার করে দিতাম সহজে কিন্তু রাত্রে যখন মাটির ফ্লোরে একটা পাটি বিছিয়ে দুইটা কাঁথা জাতীয় কাপড়ের পোঁটলা বর্গাকৃতি করে আম্মা সেলাই করে বালিশ বানিয়ে দিয়ে ছিল ওটাতে মাথা দিয়ে শুয়ে পরতাম গায়ে একটা কম্বল ( সেই জহুর আহমেদ চৌধুরী - জয় বাংলা অফিসে আমাদেরকে দিয়েছিল ) মুড়িয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করতাম যখন ঠিক তখনি আমাকে ভয়ে পেয়ে বসত - কানের ভিতর শুনতে পেতাম পাকিস্তান আর্মির বুটের আওয়াজ - মনে হত আমাদের ক্যাম্পের পাস দিয়ে চলে যাওয়া ঐ মেঠো পথ ধরে লাইন ধরে কোমরে রাইফেল আর এল, এম জি তাক করে আমাদের ক্যাম্পের দিকে সন্তর্পণে আগিয়ে আসছে গুটি গুটি পায়ে এবং এসেই নিদ্রারত সূর্যমণিনগর স্পেশাল ক্যাম্পের সকল শরণার্থীদের নির্মম ভাবে হত্যা করে চলে যাবে । ভয়ে শিওরে উঠতাম আর চোখ বন্ধ করে চেষ্টা করতাম ঘুমাতে ; গা' শিওরে উঠত বারে বারে, ভয়ে মুখ দিয়ে কথা বের হতো না ; আম্মা বা আপাকে ডাকার মত শক্তি পেতাম না । সারা জীবন শহরে থেকে অভ্যেশ রুমের সাথে বা  বাসার শোবার রুমের নিকটেই থাকত শৌচাগার আর ক্যাম্পের টয়লেট গুলো সেই টিলার নিচে প্রায় ৩০০ ফিট টিলার পাদদেশে । শত্রুর ভয়ে আমাদের ঘর ( ছাউনি ) থেকে একা বের হয়ে বাইরে গিয়ে পস্রাব করতে যেতেও ভয় পেতাম ; দিনের বেলার সদা কর্মঠ, সদা প্রস্তুত, সকল কাজের জন্য সদা প্রস্তুত আমি রাতের অন্ধকারে হয়ে যেতাম ভীষণ অসহায় ; ভীত এবং আশাংকাগ্রস্থ , সন্ত্রস্থ । কাউকে বলতামও না আমার এই মানসিক অবস্থার কথা ; দু' এক বার আম্মাকে বলেছিলাম আম্মা অনেক উপদেশ। উদ্দীপনা এবং সাহস সঞ্চার করতে বলতেন কিন্তু আমার জন্য অন্ধকার রাত গুলো অত্যন্ত ভয়ানক ছিল, প্রতিটি রাতই ছিল একেকটা ভয় এবং দুঃস্বপ্ন ভরা ভয়াত্তক অভিজ্ঞতা । 



10 views0 comments
bottom of page